এ অধ্যায় শেষে আমরা-
সুচিশিল্প
ফেলনা জিনিস দিয়ে শিল্পকর্ম
তুলা দিয়ে সুন্দর একটি হাঁসের ছবি তৈরি করি। এছাড়া বিভিন্ন রঙের ফুল ও পাতা দিয়ে সাজানো ফুলদানির ছবি, পাখি, বিড়াল এবং অন্যান্য জিনিস তৈরি করি। কভারসহ একটি কুশন তৈরি করি।
তুলা দিয়ে কারুকর্ম করতে গেলে মূল উপকরণ হলো তুলা তা তো বুঝতেই পারছ। ব্যান্ডেজ করার তুলা, সাধারণ পেঁজা তুলা, বিভিন্ন রং, বিভিন্ন রঙের কাপড়, পিচবোর্ড, বোর্ড কাগজ, সাদা কাগজ, কার্বন কাগজ, ময়দার আঠা, আইকা আঠা, কাঁচি, সুচ, সুতা ইত্যাদি। তবে দুরকম তুলা রয়েছে। লেখা ও কুশনের জন্য, লেপ তৈরি করার পেঁজা বা ধুনা তুলা আর ছবির জন্য স্তরে স্তরে সাজানো ব্যান্ডেজ করার তুলা। এছাড়া লাগবে-বিভিন্ন রঙের কাপড়, সাদা কাগজ, রঙিন কাগজ, পিচবোর্ড, পানিতে গোলানো রং, ময়দার ঘন আঠা, ধারালো কাঁচি, পেনসিল, কার্বন পেপার, চক, বিভিন্ন রঙের কাপড়, মোটা সাদা কাগজ অথবা বাদামি কাগজ ইত্যাদি।
এবার তুলা দিয়ে লেখার কাজ আরম্ভ করি। প্রয়োজনীয় মাপের রঙিন কাপড় নিই। লাল, নীল, সবুজ কিংবা বেগুনি যে রং আমাদের ভালো লাগে সেগুলো নিই। রং গাঢ় হতে হবে, হালকা রঙে ভালো দেখাবে না। পরিষ্কার পাকা মেঝে কিংবা টেবিলের উপর কাপড় বিছিয়ে যা লেখা হবে তা বড়ো বড়ো অক্ষরে চক দিয়ে লিখে নিই। পেঁজা তুলা দিয়ে ছোটো ছোটো বলের মতো গুটি তৈরি করি। হাতের তালুর উপর মাটি রেখে অন্য হাতের তালু দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যেমন করে রুটি বেলার আটার বল তৈরি করা হয়, ঠিক তেমনি তুলার গুটি তৈরি করি। এবার কাপড়ের ওপর চকের লেখা বরাবর ময়দার ঘন আঠার লেই লাগিয়ে তুলার গুটিগুলো চাপ দিয়ে একটি একটি করে বসিয়ে যাই। গুটি বসাবার সময় একটি অপরটির গা ঘেঁষে বসাতে হবে। কাপড়ের মধ্যে একটি আধুলির মতো গোল করে গুটির ঠিক নিচে আঠা লাগাই।
গুটিগুলো সব সমান করে তৈরি করব। একই লেখায় ছোটো-বড়ো গুটি ব্যবহার করলে লেখা ভালো দেখাবে না। গুটির ব্যাস ২ বা ৩ সেমি. পর্যন্ত হতে পারে। মোটা লেখার জন্য বড়ো গুটি আর সরু লেখার জন্য ছোটো গুটি। ছবি দেখে আমরা সহজেই তুলা দিয়ে যেকোনো লেখা লিখতে পারব।
যে ছবিটি তৈরি করব তাতে সাদা, লাল, হলুদ, কমলা, বেগুনি প্রভৃতি নানা রঙের ফুল থাকবে, আর থাকবে সবুজ পাতা ও ডাটা। থাকবে ফুলদানি, তাই নানা রঙের তুলার প্রয়োজন। পানিতে গোলানো যায় এ রকম পাউডার রং বাজারে পাওয়া যায়। যদি প্রয়োজনীয় সব ধরনের রং না পাওয়া যায় তাহলে এক রঙের সাথে অপর রং মিশিয়ে প্রয়োজনমতো রং তৈরি করে নিব। লাল ও হলুদ মিলিয়ে কমলা রং পাব, লাল ও নীল মিলিয়ে পাব বেগুনি রং। বাজারে যে সবুজ রং পাব তা গাছের পাতার সবুজ রং নয়। এই সবুজ রঙের সাথে সামান্য একটু লাল রং মিশিয়ে দিলে গাছের পাতার সবুজ রং হবে। ছবিতে যতগুলো রং ব্যবহার করব তার সব কয়টি রঙের তুলা আগেই রং করে শুকিয়ে রাখব।
তুলা দিয়ে যে ছবিটি তৈরি করব, এবার পেনসিল দিয়ে কাগজে তার ছবি আঁকি। তুলার ছবি যত বড়ো করব কাগজের ছবি ঠিক তত বড়ো করে আঁকব। ছবিতে বিভিন্ন রঙের ফুল থাকবে, তাই ফুলগুলো হবে বিভিন্ন জাতের ও ছোটো বড়ো বিভিন্ন আকারের। বিভিন্ন জাতের ফুলের পাতাও হবে বিভিন্ন আকার আকৃতির। এসব বিষয় মনে রেখে ছবিটি আঁকি। কার্বন কাগজের কালি বিছিয়ে তার ওপর পেনসিল দিয়ে আঁকা ছবিটি বসাই। ক্লিপ বা আলপিন দিয়ে কাগজগুলো একসাথে আটকিয়ে নেই, যাতে নাড়াচাড়া করলেও সরে না যায়। এবার ছবির ওপর দিয়ে প্রত্যেকটি রেখা ধরে পেনসিল চালিয়ে ছবিটি এঁকে নিব। কার্বন কাগজের ওপর বিছানো কাগজে উল্টো হয়ে ছবির ছাপ পড়ে গেছে। এ রকম আরও দু-তিনটি উল্টো ছবির ছাপ দিব। পেনসিলে আঁকা ছবিটিতে রং দিয়ে ঠিক করে নেব তুলার তৈরি ছবিতে কোন ফুলের কী রং হবে? ফুলদানির রং কী হবে? পাতার রং কেমন হবে?
আলাদা আলাদাভাবে কেটে রাখা এক এক ভাগ কাগজ নিই। ছবির ছাপের উল্টো পিঠে ময়দার আঠা লাগিয়ে নির্দিষ্ট রঙের তুলা প্রায় ১ সেমি. পুরু করে বসিয়ে চাপ দিই, যাতে ভালো করে লেগে যায়।
কাগজের সব কয়টি টুকরো এভাবে তুলা লাগিয়ে একটু শুকিয়ে নিই। ছবির চারপাশে বেশকিছু জায়গা থাকবে। এমনি মাপের এক টুকরো শক্ত পিচবোর্ড এবং পিচবোর্ডের চাইতে দৈর্ঘ্যে প্রস্থে ৫ সেমি. করে বড়ো এক টুকরো কালো রঙের ভালো কাপড় নিই। কাপড় ভালো করে ইস্ত্রি করা প্রয়োজন, যাতে কুঁচকানো না থাকে। কাপড়ের ওপর পিচবোর্ড বসিয়ে চার কিনারায় ভালো করে আঠা লাগিয়ে চারপাশের বাড়তি কাগজ ভাঁজ করে বোর্ডের সাথে সেঁটে দিই। খেয়াল রাখব বোর্ডের ওপর কাপড় যেন টান হয়ে থাকে, কোথাও যেন ঢিলা না হয়। এবার তুলা লাগানো কাগজগুলো কার্বন কাগজের ছাপ বরাবর ধারালো কাঁচি দিয়ে কেটে তুলার ফুল, পাতা, ডাঁটা, ফুলদানি ইত্যাদি তৈরি করব।
কাগজে আঁকা রঙিন ছবি দেখে তুলার ফুলদানি, ফুল, পাতা, ইত্যাদি পিচবোর্ড লাগানো কালো কাপড়ের ওপর ছবির মতো সাজাই। ঠিকভাবে সাজানো হলে এক এক অংশ তুলে পেছনের কাগজে ভালো করে আঠা লাগাই এবং আবার ঠিক জায়গায় বসিয়ে চাপ দিয়ে কাপড়ের সাথে সেঁটে দিই। খেয়াল রাখব ছবির অংশগুলো চারদিকে যেন কাপড়ের সাথে ভালো করে লাগে, কোথাও যেন উঠে না থাকে। এবার দেখি, বিভিন্ন রঙের তুলা দিয়ে তৈরি ছবিটি বেশ সুন্দর লাগছে। ফুল ও পাতাগুলো আসল ফুল ও পাতার মতো নরম নরম মনে হচ্ছে! আমরা চেষ্টা করলে এই নিয়মে আমাদের খুশিমতো সুন্দর সুন্দর ছবি তৈরি করতে পারব। ফুলের ভেতর কেশর দিতে চাইলে পাপড়িগুলো আলাদা-আলাদাভাবে কেটে মাঝখানে অন্য রঙের তুলার কেশর বসিয়ে চারদিকে পাপড়িগুলো বসিয়ে দিতে হবে। শুধু ফুল-পাতার ছবি নয়, এই নিয়মে বিভিন্ন রঙের জামা-কাপড় পরিয়ে মানুষের ছবি, পশু, পাখি, গাছপালা প্রভৃতির ছবি তৈরি করতে পারি। তুলা দিয়ে করা ছবি কাচ দিয়ে ফ্রেম করে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখলে খুবই সুন্দর দেখাবে।
আমরা বাড়িতে মাকে সেলাই করতে দেখি। আমাদের জন্য জামা-কাপড়, জামার ওপর সুন্দর নকশা ইত্যাদি অনেক সূচিশিল্প তাঁরা করেন। সুই, সুতার নানারকম কাজ আমরা নিজেরাও করি। যেমন-বোতাম লাগানো, ছেঁড়া কাপড় জোড়া দেয়া, দেওয়া, ছোটোখাটো রুমাল, টেবিলের কাপড় ইত্যাদি। গ্রামে ও শহরে অনেক বাড়িতেই আমরা কাঁথা ব্যবহার করি। কিছু আছে সাধারণ কাঁথা আবার কিছু আছে নকশিকাঁথা। কাঁথায় অনেক রঙের সুতা দিয়ে সেলাই ও নকশা থাকে। দেখতেও খুব চমৎকার। কাঁথায় পাখি, মাছ, ফুল, লতাপাতা, হাতি, ঘোড়া, মানুষ ইত্যাদি অনেক কিছুই রঙিন সুতায় সেলাই করে ছবি ও নকশা আকারে তুলে ধরা হয়। আবার অনেকে ছোটো ছোটো নকশিকাঁথা ছবির মতো বাঁধাই করে ঘরে সাজিয়ে রাখে। এই যে শিল্প, একে আমরা বলি সূচিশিল্প। এই শিল্প চারুশিল্পের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। বহুকাল ধরে নানি-দাদিরা নানারকম নকশা করা পাখা, তোয়ালে, জায়নামাজ, কাঁথা ইত্যাদি সেলাই করতেন। অবসর সময় তাঁরা অনেকদিন ধরে এক একটি কাঁথা তৈরি করতেন। সুই, সুতা দিয়ে নিজেদের সুখ-দুঃখের কাহিনি নকশা করে ফুটিয়ে তুলতেন। বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে সাধারণ পরিবারের মহিলারা এখনো নানারকম নকশিকাঁথা তৈরি করছেন। এই নকশিকাঁথার পরিচিতি ও খ্যাতি লোকশিল্প হিসেবে পৃথিবীর সর্বত্র। বাংলাদেশের বিভিন্ন জাদুঘরে ও পৃথিবীর অন্যান্য সংগ্রহশালায় বাংলাদেশের এই লোকশিল্পের সংগ্রহ রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে এই শিল্পের বেশ প্রচলন হয়েছে। নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়েও বাজারে বিক্রি হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে এর কদর বেড়েছে। এই ধরনের লোকশিল্প রপ্তানি করে আমাদের দেশে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। সুচিশিল্প সাধারণত গ্রামের মেয়েরাই বেশি করে থাকে। এই শিল্প আমাদের সৌন্দর্যবোধের মান উন্নয়ন করে এবং প্রয়োজনও মেটাতে সাহায্য করে। সুই, সুতার কাজ করা রুমাল, টেবিলের কাপড়, শাড়ি, কামিজ, ওড়না, প্যান্ট, ছোটো শিশুদের ফ্রক, পর্দা ইত্যাদি দেখতে খুবই সুন্দর। আমরা নিজেরাও এ ধরনের জামা-কাপড় পরতে খুব পছন্দ করি। তাই এই শিল্প শিখে নিজ নিজ প্রয়োজন মিটিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারব। সেলাই ফোঁড়ের কাজের প্রধান বিষয় হলো নানা ধরনের ফোঁড় ও নানা রঙের সুতার যথাযথ ব্যবহার।
উপকরণ
সরু ও মোটা নানা ধরনের সুই। সাদা ও রঙিন সুতা বা উল। কাপড়ে দাগ দেওয়ার জন্য পেনসিল। প্রয়োজনমতো কাপড় অথবা চট। একটি ছোটো কাঁচি। একটি ফ্রেম (সুই-সুতায় সেলাই করার জন্য)। উপকরণ রাখার জন্য একটি বাক্স বা কৌটা। কাপড়ে মাপ দেওয়ার জন্য স্কেল বা মাপ দেওয়ার ফিতা। উপকরণ তো হলো!
এবার কাপড় বা চটে সুই, সুতা দিয়ে সেলাই করে নকশা করতে হলে আমাদের নানা ধরনের ফোঁড় জানা দরকার। সূচিশিল্প বা এমব্রয়ডারি কাজে অনেক ধরনের ফোঁড় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এখানে কয়েকটি ফোঁড় ও এগুলো কীভাবে করতে হয়, ফোঁড়গুলোর চেহারা কেমন তা বুঝতে পারব ও ফোঁড়গুলো তুলতে পারব।
ফোঁড়গুলোর নাম
১। রানিং ফোঁড় বা রান সেলাই
২। হেম ফোঁড় বা মুড়ি সেলাই
৩। বখেয়া ফোঁড়
৪। স্টেম ফোঁড়
৫। চেইন ফোঁড়
৬। লেজি-ডেইজি ফোঁড়
৭। ব্রুস ফোঁড়
৮। তারা ফোঁড়
৯। বোতাম ঘর ফোঁড়
১০। কম্বল ফোঁড়
১১। সার্টিন ফোঁড়
১২। হেরিংবোন ফোঁড়।
রানিং ফোঁড় বা রান সেলাই
বিভিন্ন ফোঁড়ের মধ্যে রানিং ফোঁড় বা রান সেলাই সবচেয়ে সহজ। যে কাপড়ের ওপরে সেলাই করব সেটিকে বাঁ হাত দিয়ে একটু উঁচু করে ধরে ডান হাতে সুঁই নিয়ে সেলাই করব। কাপড় বাঁ হাতের ওপরে রেখে বুড়ো আঙুল দিয়ে অবশিষ্ট চারটি আঙ্গুলের উপর কাপড়খানাকে চেপে ধরি, ডান হাতে সুই ধরে, একবারে ৩ থেকে ৪টি ফোঁড় করা যাবে। তবে প্রতিবারই ৩-৪টি ফোঁড় দেবার পর, সুতা টেনে সেলাইটি শক্ত করে নেব। রানিং ফোঁড় শেখার জন্য সাদা কাপড় হলে রঙিন সুতা, রঙিন কাপড় হলে সাদা সুতা ব্যবহার করব। কারণ এতে সেলাই সোজা ও সমান হচ্ছে কিনা তা সহজেই বুঝতে পারব। এই ফোঁড় দিয়ে যেমন রেখা সেলাই করা যায়, তেমনি ভরাট সেলাইও করা যায়। নকশিকাঁথায় রানিং ফোঁড় বহুলভাবে ব্যবহার করা হয়।
টেবিলের কাপড়, রুমাল, জামা ইত্যাদি কাপড়ে তৈরি যে কোনোটির কিনারা মুড়ে সেলাই করার জন্য এই ফোঁড় ব্যবহার করা হয়। টেবিলের কাপড়, রুমাল, জামা ইত্যাদি কাপড়ে তৈরি যে কোনোটির কিনারা মুড়ি সেলাই করবার জন্য যে ফোঁড় ব্যবহার করা হয় তাকে হেম ফোঁড় বা মুড়ি সেলাই বলে। এই সেলাই করার সময় কাপড়ের কিনারা এমনভাবে ভাঁজ করে নেব, যাতে কিনারার সুতাগুলো বেরিয়ে না পড়ে। এই ফোঁড় দিয়ে কুশন, জামা, শাড়ি, টেবিলের কাপড় ইত্যাদিতে অ্যাপ্লিক নিয়মে নকশা করা যায়। অ্যাপ্লিক হলো রঙিন কাপড় কেটে অন্য কাপড়ের ওপর বসিয়ে নকশা করা। হেম বা মুড়ি সেলাই শিখে নিলে আমরা অ্যাপ্লিক পদ্ধতিতে নানা রকম কাজ করতে পারব।
বখেয়া ফোঁড় সোজা দিকে মেশিনের সেলাই-এর মতো দেখতে হয়। এই ফোঁড় তুলতে হলে, রানিং ফোঁড়ের মতো নিচ থেকে ওপরে সুই চালিয়ে ফোঁড় তুলতে হয়। পরে সামান্য একটু সামনে আবার ওপরে সুই দিয়ে ফোঁড় তুলে আনি। সুই এর মুখটি আবার আগের ফোঁড়ের কাছে ফিরিয়ে আনি। পুনরায় ওপর থেকে নিচে ফোঁড় তুলি। এভাবে বার বার ফোঁড় দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাই। দেখব মেশিনের সেলাইয়ের মতো সেলাই হয়েছে। এই ফোঁড় সাধারণত জামা-কাপড়ের জোড়া লাগাতে প্রয়োজন হয়। বখেয়া ফোঁড়ের জোড়া খুব শক্ত হয়। তাছাড়া এই ফোঁড় দিয়ে নানা রকম নকশাও করা যায়। যেমন-২৫ সেমি. চওড়া ও ২৫ সেমি. লম্বা কাপড়ে প্রথমে পেনসিলে একটি মাছের ছবি এঁকে রেখা অনুযায়ী বখেয়া ফোঁড় তুলে মাছের ছবিটি ফুটিয়ে তুলতে পারি। অন্যান্য যেকোনো নকশাও বখেয়া ফোঁড় দিয়ে করতে পারব।
ডাল ফোঁড় সাধারণত গাছের ডাল, ফুল ও পাতার ডাল, লতা ইত্যাদি নকশা সেলাই করবার জন্যে ব্যবহার করা হয়। এই ফোঁড় দিয়ে রেখার আকারে সেলাই করে গেলে, রেখাটি দড়ির মতো প্যাচানো প্যাঁচানো দেখা যায়।
ডাল ফোঁড় দিয়ে সেলাই করবার সময় ফোঁড়গুলো পর পর সামনে থেকে পেছনের দিকে আসবে। সুচে সুতা পরিয়ে সুতার মাথায় গিঁট দিই। সুচের মাথা কাপড়ের নিচ দিক দিয়ে ওপরে তুলি। সুচের মাথা যেখানে উঠল তার থেকে সামান্য পেছনে বাঁ দিকে একটু সরিয়ে, সুঁই ঢুকিয়ে, ফোঁড় দুটির মাঝামাঝি জায়গায়, ডান
দিকে একটু সরিয়ে সুচের মাথা উঠাই। এবার সুচের মাথা যেখানে উঠল তার পেছনে বাঁ দিকে একটু সরিয়ে আবার সুচের মাথা ঢোকাই এবং শেষ দুই ফোঁড়ের মাঝামাঝি জায়গায় একটু ডানে সরিয়ে সুচের মাথা ওঠাই। এভাবে একের পর এক ফোঁড় দিয়ে সামনে থেকে পেছনের দিকে আসতে থাকি। দেখি সেলাই কেমন সুন্দর দেখাচ্ছে!
এই ফোঁড় দেখতে অনেকটা শেকলের মতো। চেইন ফোঁড়ের জন্যে অপেক্ষাকৃত একটু মোটা সুতা নিই। সুতার শেষ মাথায় শক্ত করে গিঁট দিই। অথবা শক্ত করে একটি ফোঁড় তুলি। সুই, - সুতা টেনে ওপরে তুলি। এবার সুচের মাথায় ডান হাত বাঁয়ে সুতা ঘুরিয়ে একটি ফোঁড় তুলি। দেখব ফোঁড়টি একটি বেড়ির মতো হয়েছে (হাত ঘুরাবার সময় সুতা কিছুটা ঢিলে রাখবে)। সুচটিকে এবার আগের ফোঁড়ের পাশ দিয়ে ঢুকিয়ে নিচ থেকে ওপরে তুলি। ফোঁড় তোলার সময় সুচ, সুতার ওপর সবসময় রাখতে হবে। সুতা আবার ডান থেকে বাঁয়ে ঘুরিয়ে ফোঁড় তুলি। এভাবে ফোঁড়ের পাশ দিয়ে সুই ঢুকিয়ে নিচ থেকে ওপরে সুতা আনি।
চেইন ফোঁড় দিয়ে যেকোনো পোশাকে নকশা করা যায়। বিশেষ করে জামা, শাড়ি, রুমাল, টেবিলের কাপড় ইত্যাদিতে ফুল, লতাপাতা করা যায়। ভরাট কাজেও এই ফোঁড় ব্যবহার করতে পারব। চিত্রকলায় বৈচিত্র্য আনতে এই সেলাই ব্যবহার করতে পারব।
লেজি-ডেইজি ফোঁড় চেইন ফোঁড়ের মতোই করতে হয়। তবে চেইন সেলাইয়ে ফোঁড়গুলো লাইন ধরে সামনে এগিয়ে যায় এবং এ ফোঁড়গুলোর আলাদা আলাদা এক-একটি চেইন ফোঁড় থাকে। রুমাল, ছোটোদের জামা-কাপড় বা যেকোনো পোশাক-পরচ্ছিদ থোকা থোকা ফুল, নকশা, লতা, পাতা ইত্যাদি এই ফোঁড় দিয়ে করলে চমৎকার দেখায়।
এবার রুমালে ফুল লতা-পাতার নকশা এঁকে তাতে লেজি-ডেইজি ফোঁড় তুলে নকশাটি ফুটিয়ে তুলি। বিভিন্ন রকমের ফোঁড় শেখা হলো। এবার একটি রুমাল ও টেবিলের কাপড় তৈরি করার চেষ্টা করি। রুমাল প্রত্যেকেরই প্রয়োজন। আমরা স্কুলে বা অন্য কোথাও বের হবার সময় সাথে একটি রুমাল রাখি। তাহলে প্রথমেই একটি রুমাল তৈরি করা শিখি। রুমাল সেলাই শিখে নিজে ব্যবহার করতে পারব। অন্যদেরও উপহার দিতে পারব।
এই ফোঁড় অনেকটা ব্রুস বা গুণ চিহ্নের মতো। ক্রস ফোঁড়ের জন্য সাধারণত নেট কিংবা সেলুলা কাপড় ব্যবহার করা হয়। সেলুলা কাপড়ের জমি ঘর ঘর করা ছকের মতো। চটের ওপরও এই ফোঁড় সুন্দরভাবে করা হয়।
তারা ফোঁড় হলো অনেকটা ব্রুস ফোঁড়ের মতো। ছবি দেখে অনায়াসে এই ফোঁড় তুলতে পারব। এই ফোঁড় সাধারণত চেক কাপড় বা চটে করা সহজ।
জামা কাপড়ে বোতাম ঘর কাটার পর কাটা অংশ থেকে যাতে সুতা বেরিয়ে না আসতে পারে সেজন্য সেলাই করে বোতাম-ঘরের মুখ বেঁধে দেওয়া হয়। বিশেষ ধরনের যে ফোঁড় দিয়ে এই সেলাই করা হয় তাকে বলে বোতাম ফোঁড়।
গায়ের শাল, কম্বল ইত্যাদির প্রান্ত সেলাই করার জন্য এই ফোঁড় ব্যবহার করা হয়। কম্বল ফোঁড় খুবই সহজ। অনেকটা বোতাম ঘর ফোঁড়ের মতো
সার্টিন ফোঁড়ও বেশ সহজ। ছবি দেখেই আশা করি আমরা করতে পারব। এই ফোঁড় পাশাপাশি তুলতে হয়।
এই ফোঁড় অনেকটা ব্রুস ফোঁড়ের মতো। ক্রস ফোঁড় যেভাবে করতে হয়, এই ফোঁড়ও অনেকটা সেভাবেই করব। ছবি দেখে আশা করি সহজেই ফোঁড়টি আমরা বুঝতে পারব।
ফেলনা জিনিস দিয়ে শিল্পকর্ম
কোনো কাজে লাগবে না ভেবে জিনিস আমরা ফেলে দিই, সেগুলোকেই বলি ফেলনা জিনিস। একটু চিন্তা করে নিজের কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে এসব ফেলনা জিনিস দিয়েও আমরা অনেক সুন্দর-সুন্দর শিল্পকর্ম তৈরি করতে পারি। প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায় এমন অনেক জিনিসই আমাদের আশপাশে ছড়িয়ে আছে যা সাধারণভাবে আমাদের চোখে ফেলনা। আমরা খুব একটা খেয়াল করি না, তেমন নজরে পড়ে না এমন সব জিনিস দিয়েও অনেক সুন্দর-সুন্দর জিনিস তৈরি করা যায়। সুন্দর কিছু তৈরি করার প্রবল ইচ্ছা ও কল্পনা শক্তি এ দুটিকে কাজে লাগালেই আমরা গাছের শুকানো ডালপালা, পাটকাঠি, কাঠের টুকরা ইত্যাদি ফেলনা জিনিসকে রূপে-রসে ভরে দিয়ে প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয় শিল্পকর্মে রূপায়িত করতে পারি। এমনি দু-একটি শিল্পকর্মের কথা জেনে নিই।
শুকনো ডালে কাগজের ফুল
বরই গাছের ছোটো একটা কাঁটাওয়ালা ডাল নিই। অন্য কোনো গাছের ডাল নিলেও চলবে, তবে তাতে কাঁটা থাকতে হবে। সাদা কিংবা হালকা হলুদ রঙের ঘুড়ির কাগজ নিয়ে ২.৫০ সিমি. চওড়া ফালি করি। কাগজের ফালি তিন চার ভাঁজ করে ২.৫৪ সেমি. চওড়া ও ১৫ সেমি. লম্বা করি। এবার কাঁচি দিয়ে কাগজের ফালির একপাশ চিকন-চিকন করে কাটি, অপর পাশে মোটামুটিভাবে ৬ সেমি. মতো জায়গা আগাগোড়া জোড়ানো থাকবে, যেন কাটা না হয়। এভাবে কাটা কাগজের ফালিটি কিছুটা চিরুনির মতো মনে হবে। কাগজের ফালি কাটা হয়ে গেলে ভাঁজ খুলে নিই।
পাটকাঠির মাথার সরু অংশ বেছে কয়েক টুকরো পাটকাঠি নিই। ধারালো ছুরি বা পুরানো ব্লেড দিয়ে এক টুকরো পাটকাঠির এক মাথা সমান করে কাটি। এবার চিরুনির মতো কাটা কাগজের ফালির জোড়ানো পাশে ময়দার আঠা লাগিয়ে পাটকাঠি সমান করে কাটা মাথার ৩৫ সেমি. পরিমাণ জায়গায় কাগজের জোড়ানো অংশের মাথা বসিয়ে পেঁচিয়ে যাই। এক পেঁচের ওপর অন্য পেঁচ পড়বে। এভাবে পাঁচ-ছয় পেঁচ দওয়ার পর কাগজের ফালি ছিঁড়ে আলাদা করে নিই। এবার ধারালো ছুরি বা ব্লেড দিয়ে কাগজের পেঁচ ঘেঁষে কাগজ সমেত পাটকাঠির মাথাটি কেটে নিই। এবার পাটকাঠির টুকরোয় পেঁচানো কাটা কাগজের সরু মাথাগুলো চারদিকে সমান করে ছড়িয়ে দিই। কী সুন্দর ফুল হয়ে গেল!
এভাবে একই পাটকাঠির মাথায় বার বার চিরুনির মতো কাটা কাগজ পেঁচিয়ে কেটে নিয়ে একটির পর একটি ফুল তৈরি করতে পারি। এক টুকরো পাটকাঠি শেষ হয়ে গেলে আরেক টুকরো নেব। প্রয়োজনীয় পরিমাণে ফুল তৈরি হয়ে গেলে শুকনো ডালের এক একটি কাঁটায় এক একটি ফুল গেঁথে বসিয়ে দিই। ডালের কাঁটার চেয়ে ফুলের নিচের পাটকাঠির টুকরো অনেক নরম, তাই গাঁথতে কষ্ট হবে না। সমস্ত ডালটি ফুলে ফুলে ভরে দিই। কত সুন্দর লাগছে। ছোটো একটা ফুলের টবে মাটির মধ্যে ফুলের ডালটি পুঁতে একটা মানানসই জায়গায় রাখি। দূর থেকে দেখি সবাই যখন আসল ফুল বলে ভুল করবে তখন আমাদের কেমন আনন্দ হবে।
মোজাইক ছবি
৮-১১ ইঞ্চি কাপড় ও আইকা আঠা নিই। কাপড়ের ওপর একটি পাখি আঁকি। এরপর বিভিন্ন রঙের কাগজ লাগিয়ে কাপড়ের ফুলের ওপর একটার পর একটা ঠিকভাবে সাবধানে লাগাই। পাখির বাইরে অন্য রঙের টুকরো লাগাতে হবে। দুদিন এভাবে রেখে দিই। পরে ফ্রেম করে ঘরে টানাতে পারব। এটি তৈরি করতে খুব আনন্দ পাব।
এভাবে ইচ্ছে করলে রঙিন কাগজ দিয়েও একইভাবে যেকোনো ফুল, হাতি বা যেকোনো মোজাইক ছবি তৈরি করতে পারব।
আলু ও ঢ্যাঁড়শ কেটে রঙে ডুবিয়ে ছাপচিত্র
আলু, ঢ্যাঁড়শ অথবা করলা কেটে যেকোনো রং দিয়ে ছাপ দেওয়া যায় (বৃত্তের নমুনা অনুসারে)। আলু, ঢ্যাঁড়শ ও করলা অথবা ছাপ দেওয়া যায় এ ধরনের যেকোনো তরকারি কেটে এবং সেটি দিয়ে কাগজে রঙের ছাপ দিয়ে সুন্দর নকশা তৈরি করা যায়। এছাড়াও বিভিন্ন নতুন ধরনের জিনিস দিয়ে ছাপ দিলে সুন্দর-সুন্দর প্যাটার্ন তৈরি করা যায়।
প্রয়োজনীয় তথ্য
পানি দিয়ে গোলানো যে কোনো রং এক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে। এই ছবিতে আলু জাতীয় কোনো নরম বস্তু প্রথমে মসৃণ করে টুকরো কেটে নিয়ে তারই একাংশ গর্ত করে খুদে নিয়ে কীভাবে ছাপানোর উপযোগী সাময়িক ব্লক করে নিতে হবে তা দেখানো হয়েছে। ঐ খোদাইকৃত অংশে রং লাগিয়ে তা দিয়ে নির্দিষ্ট কাগজে বা কাপড়ে ছাপ মারলেই চমৎকার নকশার সৃষ্টি হবে।
ফেলনা কাগজের মুখোশ তৈরি
ফেলে দেয়া অনেকগুলো কাগজ জোগাড় করি। কাগজগুলো ১ দিন পানিতে ভিজিয়ে রাখি। আটার লেই তৈরি করি (জ্বাল দিয়ে)। এবার কাগজ পানি থেকে চিপড়িয়ে তুলে নিই। আটার লেইয়ের সাথে কাগজের জিনিসগুলো মিশিয়ে নিই।
এতে মন্ড তৈরি হবে। মন্ডের সাথে একটু তুঁত মিশিয়ে নিতে হবে। তা না হলে পোকায় কেটে ফেলবে।
অনেকগুলো শুকনো কাগজ, দড়ি বা সুতলি দিয়ে গোল করে মাঝারি বলের আকার তৈরি করি। এবার বলের উপরের দিকে মাটির মতো কাগজের মণ্ড দিয়ে যেকোনো বিড়াল বা মানুষের মুখের আকৃতি করি। দুই-তিন দিন শুকাতে দিই। শুকিয়ে গেলে নিচ থেকে কাগজের বলটি বের করে ফেলি। মানুষ বা বিড়ালের মুখোশ তৈরি হয়ে গেল। এবার রং করি। (ছবি দেখে করতে পারব)
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১. সুচিশিল্প বলতে কী বোঝায়?
(ক) পোশাক পরিচ্ছদ
(খ) সুই-সুতার মাধ্যমে তৈরি নকশা বা শিল্পকর্ম
(গ) চিত্রকর্ম
(ঘ) এক ধরনের কারুশিল্প।
২. চেইন ফোঁড় দিয়ে কোনটি করা যায়?
(ক) রেখা সেলাই
(খ) রেখা ও ভরাট কাজ
(গ) শুধু মোটা রেখা সেলাই
(ঘ) মুড়ি সেলাই।
৩. বোতামঘর ফোঁড় কোনটিতে ব্যবহার করা হয়?
(ক) শুধু বোতামঘর সেলাইয়ের জন্য
(খ) বোতামঘর ও অন্যান্য ফুল লতা ইত্যাদি সেলাইয়ের জন্য
(গ) শুধু লতাপাতা সেলাই করার জন্য।
৪. তুলা দিয়ে ছবি করতে হলে প্রথমে-
(ক) ছবির কাপড়ের ওপর পেনসিল দিয়ে ছবি আঁকতে হয়
(খ) তুলা কেটে কেটে বসিয়ে দিতে হয়
(গ) তুলার ওপর ছবি এঁকে কাটতে হয়
(ঘ) কাগজের ওপর আগে ছবি এঁকে নিতে হয়।
৫. ছবি তৈরির জন্য উপযোগী তুলা কোনটি?
(ক) সাধারণ পেঁজা তুলা
(খ) শিমুল তুলা
(গ) ব্যান্ডেজের তুলা
(ঘ) কার্পাস তুলা
৬. তুলা দিয়ে রঙিন ছবি তৈরি করতে হলে কোনটি করবে?
(ক) ছবি তৈরি করার পর রং লাগানো হয়
(খ) এক এক অংশ কেটে কেটে রঙে চুবাতে হয়
(গ) আগেই তুলা রং করে শুকিয়ে রাখতে হয়
(ঘ) ছবি তৈরি করার পর তুলা রং করতে হয়।
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. সুচিশিল্প কী? সূচিশিল্পের ৫টি উপকরণের নাম লেখো।
২. পাঁচটি ফোঁড়ের নাম লেখো এবং এগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রসমূহ উল্লেখ করো।
৩. তোমরা বিভিন্ন প্রকার ফোঁড় শিখতে আগ্রহী কেন?
ব্যবহারিক (activity)
১. একটি রুমাল তৈরি করে তাতে ডাল ফোঁড়, লেজি-ডেইজি ফোঁড় ও বোতাম ঘর ফোঁড় দিয়ে একটি নকশা সেলাই করো।
২. তুলা দিয়ে একটি পুতুল ও ফুলদানি বাড়ি থেকে তৈরি করে জমা দাও।
৩. ফেলনা জিনিস দিতে তোমার মনের মতো একটি শিল্পকর্ম করে জমা দাও।
৪. কাগজে বিভিন্ন উপাদানের ছাপ দিয়ে প্রদর্শন করো।
৫. রঙিন কাগজের টুকরা ব্যবহার করে একটি মোজাইক চিত্র তৈরি করো।
Read more